মঙ্গলবার ০৩ জুন ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বঙ্গাব্দ
আইন

পরিবহন খাতে শাজাহান খানের ২৪ হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি

নিজস্ব প্রতিবেদন ২২ অক্টোবার ২০২৪ ১২:৩৩ পি.এম

পরিবহন খাতে শাজাহান খানের ২৪ হাজার কোটি টাকার চাঁদাবাজি ছবি: সংগৃহীত

২০০৮ সালের নির্বাচনী হলফনামা অনুযায়ী বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান ছিলেন ঋণগ্রস্ত, সেসময় ৪২ লাখ টাকার বেশি ঋণ ছিল তার। তবে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দ্রুত দিন বদলাতে থাকে তার।

আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের শাসনামলে অন্তত ২৪ হাজার কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন সাবেক নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। নিজে পরিবহন শ্রমিক না হয়েও শ্রমিক সংগঠনের নেতা সেজে এই খাতে অলিখিত মাফিয়া হয়ে ওঠেন তিনি।গত ১৬ বছরে শাজাহান খান কী পরিমাণ চাঁদাবাজি করেছেন এবং সেই অর্থ কোথায় কিভাবে ব্যয় হয়েছে—এসব তথ্য পেয়েছে দৈনিক কালের কণ্ঠ। সংশ্লিষ্ট শ্রমিক নেতা ও ব্যক্তি এবং পরিবহন খাতসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এবং সরেজমিনে গিয়ে এসব তথ্য জানা যায়।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, প্রতিটি নিবন্ধিত যানবাহন থেকে ৫০ টাকা হারে চাঁদা আদায় করত শ্রমিক ফেডারেশন।

প্রতিবছর দিনের ও যানবাহনের সংখ্যায় কমবেশি থাকায় প্রতি দুই বছর করে হিসাব করা হয়েছে। সেখানে দুই বছরের মোট দিনের সঙ্গে নিবন্ধিত যানবাহন বিবেচনায় নিয়ে চাঁদার পরিমাণ বের করা হয়েছে। ২০০৯ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাবে বাণিজ্যিক যানবাহনের সংখ্যা ছিল তিন লাখ ৯১ হাজার ২৪৭। ২০০৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব গাড়ি থেকে মোট এক হাজার ৩৬৭ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়।

অন্যদিকে ২০১১ ও ২০১২ সালের পুরো সময়ে মোট চার লাখ ৮৪ হাজার ৭০৬টি গাড়ি থেকে এক হাজার ৭৬৯ কোটি টাকা এবং ২০১৩ ও ২০১৪ সালের পুরো সময়ে পাঁচ লাখ ৬৯ হাজার ৮৬৭টি গাড়ি থেকে দুই হাজার ৮০ কোটি টাকা আদায় করা হয়।

২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৭৩০ দিনে ছয় লাখ ৭০ হাজার ৬১টি গাড়ি থেকে ৫০ টাকা করে দুই হাজার ৪৪৬ কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়। ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ৭৩০ দিনে সাত লাখ ৯৩ হাজার ৩১০টি গাড়ি থেকে দুই হাজার ৮৯৫ কোটি টাকা চাঁদাবাজি হয়। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭৩০ দিনে আট লাখ ৯৮ হাজার ৬২৭টি গাড়ি থেকে চাঁদা তোলা হয় তিন হাজার ২৮০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নির্দেশিকা অনুযায়ী, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই পর্যন্ত মোট চাঁদা আদায় করা হয় ছয় হাজার ৯৪ কোটি টাকা।

সব মিলিয়ে নিবন্ধিত যানবাহনের মাধ্যমে প্রায় ১৯ হাজার ৯৩১ কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়।

এ ছাড়া অনিবন্ধিত অটোরিকশা, অটোটেম্পো রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন লাখ, ব্যাটারিচালিত ইজি বাইক ছয় লাখ, নছিমন-করিমন-আলমসাধু ও ভটভটি তিন লাখ। ফলে দেশে অনিবন্ধিত যান রয়েছে প্রায় সাড়ে ১২ লাখ। এসব যানবাহন থেকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ২৪৯টি ইউনিয়ন বেআইনিভাবে নিয়মিত হারে চাঁদা আদায় করে। 

এসব চাঁদার এক-পঞ্চমাংশ কল্যাণ তহবিলের নামে ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা দিতে হয়। গত ১৫ বছরের বেশি সময়ে এই খাতে পাঁচ হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদা হিসেবে শ্রমিক ফেডারেশনে জমা হয়েছে, কিন্তু এসব টাকার সর্বজনীন সুফল শ্রমিকরা পাননি।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোকলেছুর রহমান ছিলেন শাজাহান খানের ঘনিষ্ঠ সহচর। শাজাহান খানের প্রভাব খাটিয়ে তারা সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং বিআরটিএর চেয়ারম্যানকে বিভিন্ন বেআইনি কাজ করাতেন। এর মধ্যে অন্যতম মিশুক যানের প্রতিস্থাপন। 

২০১২ সালে তৎকালীন সরকারের সময় যেসব মিশুকের আয়ুষ্কাল ৯ বছর উত্তীর্ণ হয়, সেখান থেকে প্রকৃত মালিকদের মধ্যে দুই হাজার ৬৯৬টি মিশুক প্রতিস্থাপন করা হবে মর্মে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। কিন্তু প্রকৃত মালিকদের বাদ দিয়ে অন্যদের এই সুবিধা দিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেন দুজন। দুজনই অঢেল সম্পত্তির মালিক।

এর মধ্যে ওসমান আলীর রয়েছে রাজধানীতে দুটি ফ্ল্যাট, গাজীপুরে স্ত্রীর নামে মার্কেট, পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের নামে ২০টির বেশি বাস, সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশন রয়েছে। এই সিএনজি স্টেশনটি আবার সলিড ব্যাটারির বাংলাদেশের একমাত্র পরিবেশক। শেরপুরে রয়েছে ২০০ বিঘার ওপর বাগানবাড়ি।

জানতে চাইলে শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ হানিফ খোকন বলেন, শাজাহান খান শ্রমিক কল্যাণের নামে নিজের কল্যাণ করেছেন। নিজের সম্পদের পাহাড় গড়তেই ব্যস্ত ছিলেন। আর আশপাশের লোকজনের অঢেল সম্পত্তি তৈরিতে সহায়তা করেছেন। মন্ত্রী হয়েও শ্রমিকদের কল্যাণে তিনি কোনো ভূমিকা রাখেননি।

জানা গেছে, ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা অনুযায়ী শাজাহান খানের নিজ নামে স্থাবর সম্পদ ছিল মাত্র তিনটি স্থানে। গ্রামের বাড়িতে যৌথ মালিকানায় স্থাবর সম্পত্তি ছিল। ২০২৪ সালে শাজাহান খানের নিজ নামে স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে কমপক্ষে ১৫টি স্থানে। এ ছাড়া যৌথ মালিকানায় রয়েছে ছয়টি স্থানে। স্ত্রীর নামে স্থাবর সম্পদ রয়েছে ১৩টি স্থানে। মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর তার সম্পদ শতগুণ বেড়েছে। শাজাহান খান মূলত সার্বিক ইন্টারন্যাশনাল ব্যাবসায়িক গ্রুপের মাধ্যমে বেশির ভাগ ব্যবসা পরিচালনা করছেন। সার্বিক পরিবহনের মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে দুই শতাধিক গাড়ি। এর বাইরে নির্মাণ ও আবাসন, ফিলিং স্টেশন, কৃষি ও খাদ্য খাত, হোটেল, হাসপাতাল, প্রেস, ইটভাটা, জ্বালানি তেলের ব্যবসা এবং শিপিং ব্যবসায় বিনিয়োগ করেছেন তিনি।

পরিবহন খাতে অন্যায়ভাবে চাঁদাবাজিকে বৈধতা দেন শাজাহান খান। বছরের পর বছর শ্রমিক ফেডারেশনের নির্বাহী সভাপতির পদে থেকে স্বৈরাচার সরকারের লাঠিয়াল বাহিনীর সর্দার হিসেবে কাজ করেছেন। ২০১৩ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বাসার বিদ্যুৎ ও পানির লাইন কেটে দিয়ে তিনি ব্যাপক সমালোচিত হন।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাজধানীর ধানমণ্ডি এলাকায় কিশোর আব্দুল মোতালেব হত্যা মামলায় শাজাহান খান জেলহাজতে থাকায় শাজাহান খানের বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক তথ্য বলছে, গত ১৫ বছরে ক্ষমতার অপব্যবহার, ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী-এমপিসহ প্রভাবশালী ব্যক্তিরা যে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন, তার বেশির ভাগই তারা বিদেশে পাচার করেছেন। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের ৭০ জনের বেশি মন্ত্রী-এমপি, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী, আমলা ও পুলিশ কর্মকর্তা হাজার হাজার কোটি টাকা পাচারের সঙ্গে জড়িত। এই তালিকায় শ্রমিক নেতা হিসেবে শীর্ষে রয়েছেন সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণা তথ্য বলছে, শেখ হাসিনা সরকারের দেড় দশকের শাসনামলের মধ্যে ১৪ বছরে শুধু সড়ক ও মহাসড়ক প্রকল্পের নির্মাণকাজে ২৯ হাজার থেকে ৫০ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে।

এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সড়ক ও পরিবহন খাতে চাঁদাবাজির ব্যাপকতা ও গভীরতা অনেক বেশি। দেড় দশকের বেশি সময় ধরে দলীয় রাজনীতির কাছে এই খাতটি জিম্মি। চাঁদাবাজির বাণিজ্যের মাধ্যমে গুটিকয়েক মানুষ সম্পদশালী হচ্ছে, কিন্তু প্রকৃত মূল্য দিতে হচ্ছে জনগণকে। এটি নির্মূল করতে হলে এর পেছনের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও প্রভাবশালী শক্তিগুলোকে নির্মূল করতে হবে।

তথ্য সুত্র: ইত্তেফাক


এই সম্পর্কিত আরও খবর

আরও খবর

news image

অসুস্থ আসামিদের সেবায় হুইল চেয়ার দিলো সিএমএম

news image

জামায়াত নেতা এটিএম আজহারের আপিলের রায় আজ

news image

নতুন মামলায় গ্রেফতার সালমান, আনিসুল ও পলকসহ ৭ জন

news image

তারেক-বাবরের খালাসের বিরুদ্ধে আপিল শুনানি মঙ্গলবার

news image

আলোচিত সেই পাপিয়ার চার বছরের কারাদণ্ড

news image

মুন্নী সাহা ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৩৫টি ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ

news image

শাওন-ডিবি হারুনসহ ১২ জনের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা

news image

মানিকগঞ্জের আদালতে মমতাজ

news image

মেয়র হিসেবে ইশরাকের শপথ না পড়ানো নিয়ে রিটের আদেশ আজ

news image

৭ মাস নারীকে বাসায় আটকে রেখে ধর্ষণ করেন নোবেল, ৯৯৯-এ কল পেয়ে উদ্ধার: পুলিশ

news image

এবার শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু

news image

মাগুরায় আলোচিত শিশু ধর্ষণ-হত্যা মামলায় হিটু শেখের মৃত্যুদণ্ড

news image

জামায়াতের দাঁড়িপাল্লা প্রতীক সুপ্রিম কোর্ট প্রতিষ্ঠারও আগে : শিশির মনির

news image

হত্যা মামলায় মমতাজ ৪ দিনের রিমান্ডে

news image

সাবেক আইনমন্ত্রীর ‘বান্ধবী’ তৌফিকার অবৈধ সম্পদের পাহাড়

news image

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী পাঁচ অভিযোগ

news image

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল আজ

news image

হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর পর বিচারককে ৩ বার ‘ধন্যবাদ’ বললেন তাপস

news image

রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চিন্ময় দাসের জামিন স্থগিত

news image

বিমান বাহিনীর সাবেক প্রধানের সম্পদ ক্রোক ও ব্যাংক হিসাব ফ্রিজ

news image

নিবন্ধন ফিরে পেতে জামায়াতের আপিল দ্রুত শুনানির আবেদন

news image

খুন হয়েছেন সাগর-রুনি, হত্যায় অংশ নেন ২ জন

news image

আবরার ফাহাদ হত্যা মামলা : ২০ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহালের রায় প্রকাশ

news image

দুদকের রেকর্ড সাফল্য: ৮ মাসে ১৩ হাজার কোটি টাকার সম্পদ জব্দ

news image

চিন্ময় দাসের জামিন স্থগিতের আদেশ প্রত্যাহার, রোববার শুনানি

news image

সালমান এফ রহমান-আনিসুল হকসহ ৫ জন নতুন মামলায় গ্রেপ্তার

news image

বিএনপি নেতা আমানের ১৩ বছরের সাজা বাতিল

news image

হাসিনা-জয়সহ ১৮ জনের গ্রেপ্তার সংক্রান্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ

news image

পাপনের দুর্নীতি ও অর্থপাচার : ২৭ ধরনের নথি চেয়ে বিসিবিতে চিঠি

news image

নাসির-তামিমার মামলায় বিব্রত আদালত, পাঠালেন অন্য আদালতে