রবিবার ০৭ ডিসেম্বার ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

বঙ্গাব্দ
ফিচার

"একাত্তরের অর্জিত নামমাত্র স্বাধীনতা"

ফেরারি মিজান ১৬ সেপ্টেম্বার ২০২৫ ০৩:২৪ পি.এম

"একাত্তরের অর্জিত নামমাত্র স্বাধীনতা" ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ আমাদের স্বাধীনতা এনে দিয়েছে। এ যুদ্ধ ছিল পাকিস্তানি বৈষম্য, শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের আত্মত্যাগ ও অগণিত মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা আমাদের জন্য ছিল জাতীয় মর্যাদা পুনরুদ্ধারের মাইলফলক। তবে স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে আজ প্রশ্ন জাগে—আমরা কি সত্যিই মুক্ত? নাকি কেবল নামমাত্র স্বাধীনতা অর্জন করছি? নাকি কেবল এক প্রভাববলয় থেকে বেরিয়ে আরেক প্রভাববলয়ে ঢুকে পড়েছি?

তৎকালীন প্রেক্ষাপট: (পাকিস্তানি বৈষম্য ও মুক্তিযুদ্ধ) ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের অংশ হলেও বাঙালির কণ্ঠস্বর দমন করা হয়।রাষ্ট্রভাষা চাপিয়ে দেওয়া হয় উর্দু, বাংলার স্বীকৃতির দাবিতে ১৯৫২ সালে রক্ত দিতে হয়।

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ছিল শোষণ: পাট রপ্তানি থেকে বৈদেশিক আয়ের ৭০% এ অঞ্চলের হলেও বিনিয়োগ হতো মাত্র ২৫%। মাথাপিছু আয়, শিক্ষা ও অবকাঠামোয় পশ্চিম পাকিস্তান সব দিক থেকেই অগ্রাধিকার পেত।মাথাপিছু আয়েও ছিল ব্যাপক বৈষম্য। শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফা (১৯৬৬) ছিল এই বঞ্চনার সরাসরি জবাব। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও ক্ষমতা হস্তান্তর আটকে দেয় ইয়াহিয়া–ভুট্টো জোট। অবশেষে ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে “অপারেশন সার্চলাইট” গণহত্যা ঘটিয়ে পাকিস্তান নিজের পতন ত্বরান্বিত করে। বৈষম্যের বিরুদ্ধে সেই বিদ্রোহই ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ শেষে বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দেয়।

বর্তমান প্রেক্ষাপট: (স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা) স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশ নানা সংকটে আবদ্ধ। প্রতিবেশী ভারতের প্রভাব, অভ্যন্তরীণ বৈষম্য ও দুর্নীতি আজকের বাস্তবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।

অর্থনীতি: ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যে বৈষম্য—আমদানির ২৬% ভারত থেকে এলেও রপ্তানি মাত্র ৩–৪%।

পানি সমস্যা: গঙ্গা চুক্তি হলেও তিস্তা চুক্তি এখনো ঝুলে আছে, ফারাক্কা ও টিপাইমুখ প্রকল্প কৃষিতে ক্ষতি করছে।

সীমান্ত হত্যা: প্রতিবছর ৩০–৪০ জন বাংলাদেশি বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারান।

অভ্যন্তরীণ সংকট: দুর্নীতি, যুব বেকারত্ব (১২% এর কাছাকাছি), আর বিদেশি প্রভাবাধীন রাজনীতির অভিযোগ জনগণের ক্ষোভ বাড়াচ্ছে। ফলে স্বাধীনতার অর্ধশতক পরও সার্বভৌমত্ব প্রশ্নবিদ্ধ, যা অনেকের চোখে “নামমাত্র স্বাধীনতা”।

সাদৃশ্য ও পার্থক্য ও সাদৃশ্য: ১৯৭১ সালে যেমন বৈষম্য ও শোষণ বিদ্রোহকে ডেকে এনেছিল, আজও রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বহিঃপ্রভাব নতুন বিদ্রোহের আশঙ্কা তৈরি করছে।

পার্থক্য: তখন শত্রু ছিল বাইরের পাকিস্তান, আর আজ বৈষম্য ও প্রভাব এসেছে আংশিকভাবে ভেতরের দুর্নীতি, আংশিকভাবে প্রতিবেশী আধিপত্য থেকে। অর্থাৎ স্বাধীনতার পতাকা রয়েছে, কিন্তু নীতিনির্ধারণে সার্বভৌমত্ব সীমিত। এজন্য অনেকে একে “নামমাত্র স্বাধীনতা” বলে থাকেন।

রাজনৈতিক বিস্ফোরণের আশঙ্কা: অভ্যন্তরীণ বৈষম্য, বহিঃপ্রভাব, দুর্নীতি ও জবাবদিহিতাহীন রাজনীতি জনগণের ক্ষোভ বাড়াচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের সূচকে বাংলাদেশ বহু বছর দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় নিচের দিকে।
যুব বেকারত্ব ১২% ছুঁই ছুঁই। জরিপে দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ মনে করে, রাজনীতি বিদেশি প্রভাবাধীন। এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বিস্ফোরণ—অর্থাৎ জনগণের বিদ্রোহ—অস্বাভাবিক নয়। ১৯৭১ সালে যেমন বৈষম্য বিদ্রোহ ডেকে এনেছিল, তেমনি আজও পরিস্থিতি তীব্র হলে একই ইতিহাস পুনরাবৃত্ত হতে পারে।

উত্তরণের পথ: প্রকৃত স্বাধীনতার জন্য এখনই পরিবর্তনের পথে হাঁটা জরুরি।
১. স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়া—শুধু পোশাকশিল্প নয়, কৃষি, আইটি, ফার্মাসিউটিক্যালসকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
২. বহুমুখী কূটনীতি—ভারতের বাইরে চীন, জাপান, মধ্যপ্রাচ্য ও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে।
৩. গণতান্ত্রিক সংস্কার—স্বচ্ছ নির্বাচন, জবাবদিহিতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
4. জাতীয় ঐক্য—স্বাধীনতার চেতনা ছিল জনগণের অধিকার ও মর্যাদা; দলীয় বিভাজন তা রক্ষা করতে পারবে না।
৫. যুবশক্তির সম্পৃক্ততা—বেকারত্ব কমিয়ে তাদের রাষ্ট্রগঠনে সক্রিয় ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে।

উপসংহার:
১৯৭১ ছিল বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, যার ফসল স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু আজও আমরা বৈষম্য, দুর্নীতি ও বহিঃপ্রভাবে জর্জরিত। যদি প্রকৃত স্বাধীনতা চাই, তবে এখনই পরিবর্তনের পথে হাঁটতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে জনগণের বিদ্রোহ অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠতে পারে।

লেখক: ফেরারি মিজান
মেইল ferarimijan1@gmail.com


এই সম্পর্কিত আরও খবর

আরও খবর

news image

রাজনীতি, বুদ্ধিজীবী ও টকশো-সংস্কৃতি: বিভ্রান্ত এক দেশ

news image

পেশা নয়, সেবা—এটাই হোক রাজনীতি

news image

যেসব লক্ষণে বুঝবেন আপনার থেরাপি প্রয়োজন

news image

ইসলামিক রাজনীতি বনাম গণতান্ত্রিক রাজনীতি: মুসলমানদের অন্তর্দ্বন্দ্ব

news image

শারীরিক ও মানসিক সুস্থ থাকতে দরকার আলিঙ্গনের

news image

সঙ্গী নার্সিসিস্ট কি না চিনবেন যেভাবে

news image

৬ উপসর্গে এআই নয়, চাই সরাসরি চিকিৎসক

news image

এসিতে বিস্ফোরণ? এই ৫টি সংকেত কখনোই উপেক্ষা করবেন না!

news image

যেভাবে বুঝবেন আপনার বিশ্রাম দরকার

news image

বছরের শেষ সূর্যগ্রহণ আজ

news image

৪৩০ জনকে নিয়োগ দেবে বাংলাদেশ নৌবাহিনী, লাগবে এসএসসি পাস

news image

বাংলাদেশের স্বৈরতন্ত্রের ইতিহাস ও পি আর পদ্ধতির প্রযোজ্যতা

news image

জাপানিদের দীর্ঘ ও সুখী জীবনের রহস্য

news image

"একাত্তরের অর্জিত নামমাত্র স্বাধীনতা"

news image

শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আদর্শকে বিতর্কিত করতেছে কারা?

news image

সোলো ট্রিপের জন্য ঘুরে আসুন এই ৫টি দেশে

news image

পুরো মানুষ গিলে ফেলতে সক্ষম যে ৬টি ভয়ংকর প্রাণী

news image

চন্দ্রগ্রহণ খালি চোখে দেখা কি নিরাপদ?

news image

খোলা চিঠি

news image

দামাল কবির জন্মদিনে শ্রদ্ধা জানিয়ে মঞ্চে আবারো ‘দামাল ছেলে নজরুল’

news image

তারেক জিয়ার উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি

news image

রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় নির্বাচন ব্যবস্থা!

news image

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের প্রয়াণ দিবসে সুরেলা সন্ধ্যা

news image

রবিন রাফানের এআই মাস্টারক্লাসে অভূতপূর্ব সাড়া, দ্বিতীয় সিজনের ঘোষণা

news image

যেভাবে অনলাইনে ভাইরাল হওয়া কারওয়ান বাজারের তরমুজ বিক্রেতার জন্য কাল হয়ে দাঁড়ালো

news image

ঈদ সালামি থেকে ঈদী: সংস্কৃতির বিবর্তন

news image

সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে ৪০০ বছরের পুরোনো মসজিদ

news image

শিশু সাহিত্যের ধ্রুবতারা শিবুকান্তি দাশ

news image

জনতার কন্ঠস্বর

news image

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পাঁচ মসজিদ